Thursday 25 April 2013

ডেকে এনে শত প্রাণ হত্যা

শেষ পর্যন্ত মালিকদের লোভের ভার আর বইতে পারল না ভবনটি। ফাটল ধরা ভবনে কয়েক হাজার কর্মীকে ডেকে আনা হলো কাজে যোগ দিতে। আর ভবনটি ধসে পড়ল গরিব মানুষগুলোর মাথার ওপর। ভবনের প্রতিটি তলা যেন পাউরুটির টুকরোর মতো একটির ওপর একটি মুহূর্তে চেপে বসল, আর পিষে ফেলল তাঁদের। 
গতকাল বুধবার সকালে ধসের পর রাত ১১টা পর্যন্ত ১২৭ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে প্রশাসন। আহত হয়েছে সহস্রাধিক। ভবনটিতে এখনো অনেকে আটকা পড়ে আছেন। উদ্ধারকাজ শেষ হতে আরও দু-এক দিন সময় লাগবে। 
সাভারের রানা প্লাজার মালিক যুবলীগের নেতা সোহেল রানার নয়তলা ভবনে পাঁচটি পোশাক তৈরির কারখানা। রানার আহ্বানে কারখানার মালিকেরা গতকাল সকালে কর্মীদের ডেকে এনে কাজে যোগদান করান। আগের দিন ভবনটিতে ফাটল দেখা দিলে তাঁদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ এই ভবনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া কারখানা চালু না করতে বলেছিল মালিকদের। কিন্তু তাঁরা সে নিষেধ মানলেন না। তাঁরা শুনলেন ভবনমালিক যুবলীগের নেতার কথা। 
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে এটাই সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা। এর আগে এই সাভারের বাইপাইলে স্পেকট্রাম গার্মেন্টস ধসে ৭৬ জন মারা যান। সর্বশেষ তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড দুর্ঘটনায় মারা যান ১১৪ জন। আগুন লেগে হতাহতের এই ঘটনার রেশ এখনো কাটেনি। এর মধ্যেই ঘটল দ্বিতীয় সাভার ট্র্যাজেডি। এই ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তৈরি পোশাকশিল্পকে আবার প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবে। 
আগের দুর্ঘটনাগুলোয় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও এখনো কারও কোনো শাস্তি হয়নি। গতকালের ঘটনার পর ভবনমালিকের বিরুদ্ধে ইমারত নির্মাণ আইনে সাভার থানায় মামলা করেছে রাজউক। 
গতকাল ধসে পড়া ভবনটির ধ্বংসাবশেষ পড়ে পাশের একটি তিনতলা ভবনও মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। রানা প্লাজার তৃতীয় থেকে অষ্টম তলা পর্যন্ত ছিল পোশাক কারখানা। আর নিচের দুটি তলায় মার্কেট, ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। হরতালের কারণে মার্কেট বন্ধ ছিল। আর ভবনে ফাটল ধরায় ব্যাংকটি আগের দিনই তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়। ধসে পড়া ভবনের তৃতীয় তলায় আগের দিনই ফাটল দেখা গিয়েছিল। এ জন্য পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা গতকাল কাজে যোগ দিতে চাননি। মালিকেরা কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেছেন বলে আহত শ্রমিকেরা দাবি করেছেন। 
ভবনের মালিক সোহেল রানার নামে সাভারজুড়ে যেসব পোস্টার দেখা গেছে, সেখানে সাভার থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক পরিচয় লেখা রয়েছে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় স্থানীয় প্রশাসনও ভবন ফাটলের সংবাদে কান দেয়নি। প্রশাসনের অবহেলা ও মালিকদের দৌরাত্ম্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে উপস্থিত লোকজন বলেছেন, ‘নিরীহ মানুষগুলোকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে মারা হয়েছে।’ ভবনটিতে আড়াই থেকে তিন হাজার শ্রমিক কাজ করতেন বলে স্থানীয় লোকজন জানান।
ভবনধসের ঘটনা ঘটে সকাল নয়টার কিছু আগে। সাভারের পার্বতীনগরের বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম জানান, তিনি বাজার করতে গিয়েছিলেন। হঠাৎ দেখেন রানা প্লাজা যেখানটায় ছিল, সেখানে শুধু ধুলা উড়ছে। ভবনের গ্লাস ও ইস্পাতের পাতগুলো ছিটকে পড়ছে সড়কে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মানুষের আর্তনাদ শুনতে পান তিনি। সেখান থেকে তিনি সাতজনকে উদ্ধারও করেন। 
রানা প্লাজার দক্ষিণ পাশের তিনতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি অফিসে ২২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মশিউর রহমান বলেন, সকাল আটটা ৪০ মিনিটে তিনি রানা প্লাজার সামনেই ছিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রচণ্ড শব্দ করে ভবনটি নিচের দিকে ধসে পড়ে। ভেতর থেকে শুধু চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। পুরো এলাকা ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। 
স্থানীয় বাসিন্দারাই প্রথমে উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেন। এরপর আসে সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), পুলিশ, র‌্যাব, রেড ক্রিসেন্ট, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামসহ বিভিন্ন সংস্থা। সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলের নেতারাও আসেন। দুপুরের দিকে উৎসুক মানুষের ভিড় বাড়লে পুলিশ ফাঁকা গুলি করে এবং কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে তাঁদের সরিয়ে দেন। সাভার ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মী মোবারক হোসেন বলেন, ‘ধসে পড়া ভবনের যেখানেই হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করছি, সেখানেই ঝুরঝুর করে ভেঙে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ভবনের নির্মাণ খুবই দুর্বল হয়েছে। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ভবনটি যত বড়, সে অনুযায়ী রড, সিমেন্ট ও পাথর দেওয়া হয়নি।’ 
স্থানীয় উদ্ধারকর্মী আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘বালু, সিমেন্ট ও রড ঠিকভাবে দিয়েছে বলে মনে হয়নি। সবকিছু গুঁড়া গুঁড়া হয়ে গেছে।’ সাভার পৌরসভা সূত্র জানিয়েছে, ভবনটির প্রতিটি তলা চওড়ায় প্রায় আড়াই শ এবং দৈর্ঘ্যে এক হাজার ফুট। এর নির্মাণ শুরু হয় ২০০৭ সালে। উদ্বোধন হয় ২০১০ সালে। ভবনের জায়গার একাংশ ডোবা ছিল।
কয়েক মুহূর্তে সব শেষ: আহত শ্রমিকেরা জানান, গতকাল সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত ধসে পড়ার আতঙ্কে পোশাকশ্রমিকেরা ভবনে প্রবেশ করেননি। কিন্তু পোশাক কারখানার কর্তৃপক্ষ ভবনের কিছু হয়নি বলে কাজে যোগ দিতে বাধ্য করে। পরে কাজও শুরু করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু আধা ঘণ্টা পরেই নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়। 
প্রত্যক্ষদর্শী ও আহত ব্যক্তিরা জানান, প্রথমে স্থানীয় বাসিন্দারা উদ্ধার তৎপরতা চালান। এরপর ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ যোগ দেয়। একপর্যায়ে র‌্যাব ও সেনাবাহিনী উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। তবে ভবন কাটার যন্ত্র আনলে তা ব্যবহার করেননি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। হাতুড়ি ও শাবল দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে উদ্ধার চালানো হয়। 
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ ঘটনাস্থলে এসে বলেন, ভবনটি যথাযথভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল কি না, তা তদন্ত ছাড়া বলা সম্ভব নয়। দুর্বল নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করার কারণেই নিচের দিকে ধসে পড়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। উদ্ধারকাজে যন্ত্র ব্যবহার করা হলে ভেতরে আটকে পড়া লোকজন মারা যেতে পারে—এই আশঙ্কায় হাতেই উদ্ধার তৎপরতা চালানো হচ্ছে। হতাহতের সংখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভেতরে অনেক লোক আটকা পড়ে আছে। কতজন মারা গেছে আর কতজন বেঁচে আছে, উদ্ধার অভিযান শেষ না করা পর্যন্ত বলা মুশকিল।
সাভার পৌরসভার মেয়র রেফাত উল্লাহ দাবি করেন, ভবনটির ১০ তলা পর্যন্ত অনুমোদন ছিল। তিনি বলেন, ‘গত মঙ্গলবার ফাটলের ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করে বুয়েটের প্রকৌশলী দিয়ে যাচাই করার চিন্তা-ভাবনা করছিলাম। কিন্তু এর আগেই সব শেষ হয়ে গেল।’
প্রত্যক্ষদর্শী ও আহত ব্যক্তিদের কথা: অষ্টম তলায় কাজ করছিলেন কোহিনূর বেগম। তাঁকে উদ্ধার করা হয় সাড়ে ১০টার দিকে। তিনি এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বলেন, আগের দিনই ধসে পড়ার আতঙ্কে তাঁরা কারখানা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সকালে ফোন দিয়ে কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেন রানা নামের এক কর্মকর্তা। প্রথমে তাঁরা ঢুকতে চাননি। কিন্তু কর্মকর্তারা আশ্বাস দিয়েছিলেন যে তাঁরাও থাকবেন।
অষ্টম তলা থেকে বেঁচে আসা রাশিদা বেগম বলেন, ধসে পড়ার আগে ছাদ থেকে পলেস্তারা পড়তে থাকে এবং মড়মড় আওয়াজ হয়। এ সময় বের হতে চাইলে তাঁদের বাধা দেওয়া হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যে বিকট শব্দে ভবনটি ধসে পড়ে। এনাম মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন সীমা বলেন, যেসব কর্মকর্তা তাঁদের ফোন দিয়ে কাজে যোগ দিতে বলেছিলেন, তাঁরাও চাপা পড়েছেন।
সাভার নামাবাজারের বাসিন্দা শাওন জানান, তাঁর ভাই ইলিয়াসকে সকালে ফোন দিয়ে বলা হয়, কারখানায় যোগ না দিলে চাকরি থাকবে না। কাজে যোগ দেওয়ার পর তাঁর হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। 
প্রভাবশালী ভবনমালিক, প্রশাসনের গাফিলতি: গত মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে তৃতীয় তলায় ফাটল দেখে বিভিন্ন তলায় কর্মরত শ্রমিকেরা আতঙ্কে বেরিয়ে যান। একপর্যায়ে সবগুলো কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত ব্র্যাক ব্যাংকও ছুটি ঘোষণা করা হয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় তলার সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা ছিল। খবর পেয়ে গত মঙ্গলবার বিকেলে সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কবীর হোসেন সরদার ভবন পরিদর্শন করেন। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ভবন ধসে পড়ার মতো কোনো কারণ এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে না। ভবন ধসে পড়ার পর গতকাল জানতে চাইলে কবীর হোসেন বলেন, তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 
ঢাকা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মঙ্গলবার সকালে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল থেকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ফোন করে ওই ভবনে ফাটলের বিষয়টি জানানো হয়। তখনই সাভারের ইউএনওকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। ইউএনও ঘুরে আসার পর তাঁর ভবনটি একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া উচিত ছিল। এখন কী ব্যবস্থা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই প্রশ্নের কী উত্তর দেব বলেন!’
ভবনের মালিক সোহেল রানাও সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আগের দিন বলেছিলেন, শ্রমিকেরা শুধু শুধু আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কারখানা থেকে বের হয়ে যান। ভবন ধসে পড়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়নি। স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, ভবনের মালিকও গতকল সকালে সেখানে ছিলেন। সাভারে হরতালবিরোধী মিছিল করার জন্য লোক জোগাড় করছিলেন তিনি। ভবনের নিচতলায় তাঁর একটি ব্যক্তিগত কার্যালয় আছে বলেও জানা গেছে। মিছিল করতে আনা লোকজনের কেউ কেউ চাপা পড়েছেন বলেও জানিয়েছেন অনেকে। গতকাল ভবন ধসের পর এর মালিক ও পোশাক কারখানার মালিকদের পাওয়া যায়নি। সোহেল রানাকে ভবন থেকে উদ্ধারের পর আর তাঁর হদিস পাওয়া যায়নি। 
ভবনটিতে কী ছিল: রানা প্লাজা একেবারে সাভার বাসস্ট্যান্ডে, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পূর্ব পাশ ঘেঁষে অবস্থিত। নয়তলা ভবনটির তৃতীয় থেকে অষ্টম তলা পর্যন্ত ছিল পোশাক কারখানা। নবম তলা নির্মাণাধীন। নিচতলায় ছিল কয়েক শ কাপড়ের দোকান। দ্বিতীয় তলায় ইলেকট্রনিক সামগ্রীর দোকান, ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা, সিটিসেলের কাস্টমার কেয়ার সেন্টারসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়।
পোশাক কারখানার কর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ভবনের তৃতীয় তলায় ছিল নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেড এবং সপ্তম ও অষ্টম তলায় ছিল নিউ ওয়েভ স্টাইল লিমিটেড। ষষ্ঠ ও চতুর্থ তলায় ইথারটেক্স এবং পঞ্চম তলায় ছিল ফ্যান্টম অ্যাপারেলস। 
বিজিএমইএ থেকে জানা গেছে, নিউ ওয়েভ বটমস ও নিউ ওয়েভ স্টাইলের মালিক মাহবুবুর রহমান তাপস ও বজলুস সামাদ আদনান, ফ্যানটম অ্যাপারেলস ও ট্যাকের মালিক মো. আমিনুল ইসলাম এবং ইথারটেক্সের মালিক হচ্ছেন মো. আনিসুর রহমান।

0 comments:

Post a Comment