Friday 26 April 2013

‘চিৎকার দিয়া কইলাম কিছু একটা দেন ডাইন হাতটা কাটি’

ভবন ধসে পড়ার সময় রত্না বেগম ছিটকে উপুড় হয়ে পড়েন। ওপরে এসে পড়ে বয়লারের উত্তপ্ত পাইপ। তার ওপর ছাদের কঠিন কংক্রিট। পাইপের তাপে চামড়া পুড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু নড়ার উপায় নেই। দীর্ঘ ২০ ঘণ্টা ওই অবস্থায় থাকার পর গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে তাঁকে উদ্ধার করা হয়।
রানা প্লাজার মৃত্যুগহ্বর থেকে উদ্ধার পাওয়া অনেকেই শুনিয়েছেন এ রকম একেকটি মর্মস্পর্শী আর শিউরে ওঠার মতো কাহিনি।
হাসপাতালে নেওয়ার পর একটু সুস্থ হয়ে রত্না বেগম বললেন, ‘মাথার উপরেই ছাদ। কান্দে আর হাতে গরম পাইপ লাইগা রইছে। পুইড়া যাইতেছিলাম। তয় নড়বার পারতেছিলাম না। অন্ধকার। ছোড ছোড নিঃশ্বাস নিছি। চোখ বুইজা খালি কানছি।’ 

উদ্ধার পাওয়ার বর্ণনা দিয়ে রত্না বলেন, ‘হঠাৎ খটখট আওয়াজ আসে। ‘কেউ আছেন?’ ‘কেউ আছেন?’ বইলা কারা জানি চিৎকার করতেছিল। আমিও ‘বাঁচান’ ‘বাঁচান’ বলে চিল্লান দেই। পরে কয়েকটা ছেলে দেওয়াল কাইট্যা আমারে হাসপাতালে নিয়া আসে।’
ভবনধসের দিন বুধবারই উদ্ধার হন পোশাককর্মী নূপুর বেগম (২৫) একপর্যায়ে নিজের আটকে পড়া হাত কেটে ফেলবেন বলে ঠিক করেছিলেন নূপুর। সাহসী এই নারী তাঁর অভিজ্ঞতা শোনালেন এভাবে: ‘এক হাতেরও কম জায়গায় আইটকা ছিলাম। মাথা দিয়া রক্ত পড়তেছিল। আমার ডান হাতের ওপর একটা লাশ। আর লাশটার উপরে দেওয়াল। হাত বাইর করতে পারতেছিলাম না। ছোট একটা ফাঁক দিয়া দেখি, অনেকেই হাঁটতেছে। বাম হাত একটু বাইর কইরা আমি চিৎকার দিয়া কইলাম, ভাই কিছু একটা দেন, ডাইন হাতটা কাটি।’

নূপুর জানান, তাঁকে বাইরে থেকে একটা ছোট বঁটি দেওয়া হয়। কিন্তু তা দিয়ে হাত কাটতে পারেননি। অনেকক্ষণ পরে দেওয়াল তুলে কয়েকজন তরুণ তাঁকে উদ্ধার করেন।
গতকাল বেলা পৌনে দুইটার দিকে উদ্ধারকারীরা আসমা বেগম নামের এক তরুণীকে এনাম হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তখন আসমার জ্ঞান ছিল না। তবে সঙ্গে থাকা মায়ের সেবা-শুশ্রূষায় কিছুক্ষণের মধ্যেই চেতনা ফিরে পান। আসমা বললেন, সৌভাগ্যক্রমে তাঁর আঘাত লাগেনি। তবে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন। একটি ভারী মেশিনের আড়ালে থেকে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। কিন্তু তাঁর গা ঘেঁষেই পড়ে ছিল পাঁচটি মৃতদেহ!
প্রায় ২৭ ঘণ্টা পর উদ্ধার পান সপ্তম তলার কর্মী মেঘলা আক্তার। হাসপাতালে তিনি বলেন, ‘বিল্ডিং ভাইঙ্গা পড়ার লগে লগে আমি দৌড় দেই। ফ্লোরটা (মেঝে) লিফটের মতো নিচে নামতে নামতে ঘটাং কইরা থামে। আর দড়াম কইরা ছাদ ভাইঙ্গা আইসা ঠেকল মাথার একটু উপরেই। আমার আশেপাশে আরও কয়েকজন ছিল। তারা কানছিল, চিক্কুর পারতেছিল। তয় চাইরদিক অন্ধকার বইলা কাউরে দেহা যাইতেছিল না। একজন মোবাইলের লাইট জ্বালাইল। দেখলাম, আমার পাশে পইড়া আছে একটা মাইয়ার লাশ। হেরপর আমিও কান্নাকাটি শুরু করি।’
মেঘলা বেঁচে গেলেও একই ভবনে কর্মরত তাঁর স্বামী আবদুল বাতেনের খোঁজ মেলেনি এখনো।
অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে: উদ্ধারকাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম সোলায়মান গতকাল রাতে বলেন, ভবনের এক জায়গায় একসঙ্গে ১৩ জন, আরেক জায়গায় একসঙ্গে ৪০ জনকে জীবিত অবস্থায় খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা। তবে একেবারে ভেতরে থাকায় তাঁদের উদ্ধার করা যাচ্ছে না। তাঁদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য ৫০০ ফুট পাইপ দিয়ে অক্সিজেন সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খাবার ও পানীয় দেওয়ারও ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

0 comments:

Post a Comment