Friday 26 April 2013

কী নামে ডাকি তাঁদের

তাঁরা কেউ কাউকে চেনেন না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ধসে পড়া ভবনের ভেতর ঢুকে পরিচয়। পরস্পরের নামও জানা নেই। নাওয়া-খাওয়া ভুলে গত বুধবার থেকেই ভবনের ভেতর ঢুকে উদ্ধার করেন জীবিত-মৃত শ খানেক মানুষকে। এর মধ্যে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিয়ে ছুরি আর হ্যাক্সো ব্লেড চালিয়ে পা কেটে চারজনকে, হাত কেটে একজনকে জীবিত বের করে এনেছেন তাঁরা। 

দীর্ঘ পরিশ্রম আর ভবনের ভেতরের গুমোট পরিবেশে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁদের চারজনকে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে আনা হয় সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালে আসার পর চারজন পরস্পরের নাম জানতে পারেন। আর তখনই জানা যায়, এই কয়েকজন যুবকের জীবন বাজি রেখে স্বেচ্ছায় উদ্ধারকর্মী হওয়ার এক অসামান্য গল্প।
এই চারজন হলেন বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি রুবেল, স্নাতক শ্রেণীর ছাত্র আবির হোসেন, পোশাকসামগ্রীর ব্যবসায়ী মো. হাবিব ও ব্যবসায়ী কাওসার হীরা। দুই দিনের এই উদ্ধারকাজে সঙ্গী বাকি তিনজনের নাম জানাতে পারেননি এই চারজন। নাম জানার ফুরসতই তাঁরা পাননি। 
শুধু এই সাতজন নন, বুধবার থেকেই শত শত সাধারণ মানুষ জীবন বাজি রেখে চিড়েচেপ্টা হয়ে যাওয়া নয়তলা ভবনের ভেতর ঢুকে ও বাইরে থেকে উদ্ধারকাজ করে গেছেন। তাঁদের সঙ্গে ভবনের ভেতরে-বাইরে কাজ করে যাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। স্থানীয় মানুষই ভবনের ভেতর থেকে উদ্ধার করছেন, অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে বা লাশ রাখার স্থানে নিচ্ছেন, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিড় সামলাচ্ছেন, অ্যাম্বুলেন্স আর ওষুধ নিয়ে আসা যানবাহনের দ্রুত চলাচলের রাস্তা করে দিচ্ছেন, রক্ত দিচ্ছেন। এ এক অভূতপূর্ব সহমর্মিতার উপাখ্যান। তাঁরাই স্বজনের খোঁজে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষকে খাবার আর পানি দিচ্ছেন, হাসপাতাল আর লাশ রাখার জায়গা চিনিয়ে দিচ্ছেন, সান্ত্বনা আর পরামর্শ দিচ্ছেন। রাজধানী থেকে মানুষ ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে ওষুধ, খাবার আর পানি নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যাচ্ছেন।  
News in Bangladesh
ওঁরা সাতজন: স্বেচ্ছায় উদ্ধারকর্মী হয়ে পড়া সাতজনের দলটির একজন বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি মো. রুবেলের বড় বোন রিমা ও ভগ্নিপতি ফরিদ ভবনের চারতলায় ফ্যান্টম ট্যাক কারখানায় কাজ করতেন। ভবনধসের পর ফরিদ বের হতে পারলেও রিমাকে লাশ হতে হয়েছে। রিমার লাশটা আটকে রয়েছে একটা বিমের নিচে। রুবেল বোনের মৃত মুখটা দেখতে পারলেও বোনকে উদ্ধার করতে পারেননি। বোনকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েও থেমে যাননি তিনি। অন্যদের উদ্ধারে ঝুঁকিপূর্ণ এক মরিয়া লড়াইয়ে নেমেছেন সর্বশক্তি দিয়ে।
স্নাতকের ছাত্র আবিরের বাসা ঢাকার আজিমপুরে। সাভারে ভবনধসের খবর পেয়ে তিনি সেখানে যান। একপর্যায়ে নিজে থেকেই উদ্ধারকাজে জড়িয়ে পড়েন। তিনি জানান, বুধবার বেলা একটার দিকে চেপে থাকা দুই ছাদের ফোকর দিয়ে কোনোরকমে হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরে ঢোকেন তিনি। সেখানে গিয়ে দেখেন আরও ছয়জন কাজ করছেন। আবিরের দাবি, তাঁরা অন্তত দেড় শ জনকে সেখান থেকে বের করেছেন। এর মধ্যে কয়েকজন ছিলেন মৃত। 
আবির বলেন, বুধবার ভবনের ভেতরে ঢোকার পর তাঁরা কয়েকজনকে টেনে বের করেন। বিভিন্ন তলায় আটকে পড়া ব্যক্তিরা তখন চিৎকার করছিলেন। তাঁরা সেই শব্দ শনাক্ত করে করে সামান্য হাতুড়ি-ছেনি ব্যবহার করে দেয়াল ভেঙে কয়েকজনকে উদ্ধার করে আনেন। কিন্তু ভবনটি এমনভাবে ধসেছে যে দুটি ছাদের মাঝে কেবল শুয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে অল্প জায়গায় চলা যায়। কিন্তু দীর্ঘ সময় শুয়ে শুয়ে হাতুড়ি-ছেনি দিয়ে কাজ করা যাচ্ছিল না। ভেতরে যেমন প্রচণ্ড গরম, তেমন নিকষ অন্ধকার। বুকভরে শ্বাসও নেওয়া যায় না। অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠে প্রাণ। 
এই উদ্ধারকারীরা জানান, গতকাল সকাল থেকে মৃতদেহগুলো থেকে গন্ধ ছড়ানো শুরু হয়েছে। সেটাও পরিবেশ ভারী করে তুলছে। বারবার অক্সিজেন সরবরাহের জন্য বললেও কোনো কাজ হয়নি।
কীভাবে এই পরিবেশে কাজ করেছেন, প্রশ্ন করলে কাওসার হীরা বলেন, ‘দুই ছাদের মাঝের সরু জায়গায় শুয়ে পড়ে ‘কেউ আছেন’ বলে চিৎকার করি। কোনো প্রান্ত থেকে সাড়া মিললে সেখানে পৌঁছানোর চেষ্টা করি। বা বাইরে থাকা উদ্ধারকর্মীদের বিষয়টি জানাই। তখন ভেতর থেকে ফোকর করে ও বাইরে থেকে দেয়াল ভেঙে উদ্ধার করা হয় তাঁদের।’
আরেকজন স্বনিয়োজিত উদ্ধারকর্মী হাবিব ওই এলাকায় থাকেন। তিনি বলেন, গতকাল তাঁরা একজনের ওপর আরেকজন করে পড়ে থাকা তিনজন নারীকে ভবনের এক অংশে খুঁজে পান। তিনজনের একজন জীবিত ছিলেন। পাখি নামের ওই মেয়েটির একটি পা ভবনের বিমের নিচে চাপা ছিল। পরে হাঁটুর ওপর থেকে পা কেটে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন তাঁরা। কারণ, এ ছাড়া তাঁকে আর বাঁচানোর কোনো উপায় ছিল না। আরেকজন পুরুষকর্মীর গোড়ালি কেটে পা মুক্ত করে বের করে আনেন তাঁরা। 
হাবিব আর রুবেল বলেন, হাত-পা চাপা পড়ে আটকে থাকা কাউকে পেলে প্রথমে তাঁরা বাইরে অপেক্ষায় থাকা চিকিৎসকদের বিষয়টি জানান। চিকিৎসকেরাই আটকে পড়া অঙ্গ কেটে তাঁদের জীবিত উদ্ধারের সিদ্ধান্ত দেন। তবে এর জন্য উদ্ধারকারী যুবকদের চেতনানাশক ইনজেকশন প্রয়োগের কৌশল শিখিয়ে দেন চিকিৎসকেরা। পাখি নামের মেয়েটিকে উদ্ধারের ক্ষেত্রে তাঁর শরীরে চেতনানাশক দিয়ে অজ্ঞান করা হয়। তারপর চিকিৎসকদের পরামর্শমতো চাপা পড়া পা দড়ি আর ব্যান্ডেজের কাপড় দিয়ে শক্ত করে বেঁধে সরবরাহ করা ছুরি দিয়ে সেটি বিচ্ছিন্ন করেন। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পাখিকে বাইরে বের করে আনতে সক্ষম হন তাঁরা। এই উদ্ধারকাজে তাঁদের সময় লেগেছে সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা। 
রুবেল বলেন, ‘কাজ করার সময় খেয়াল ছিল না। পরে ছিন্ন অঙ্গ দেখে ঘটনাস্থলেই অজ্ঞান হয়ে পড়ি। পরে অন্যরা আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন।’
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) পরিচালক খন্দকার আবদুল আউয়াল রিজভী বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয় যে ঘটনাস্থলে অস্ত্রোপচার করে কিছু লোককে উদ্ধার করতে হবে। সে জন্য সহযোগী অধ্যাপক মো. আবদুল গণি মোল্লার নেতৃত্বে চারজন চিকিৎসকসহ কয়েজন নার্স ও ওয়ার্ডবয়ের একটি দল ঘটনাস্থলে যায়। তারা পাঁচজনকে ঘটনাস্থলে অস্ত্রোপচারের পর উদ্ধার করে।
দীর্ঘ সময় না খাওয়া, পরিশ্রম ও অতিরিক্ত ঘামের ফলে এসব উদ্ধারকর্মী পানিশূন্যতায় আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে এনাম মেডিকেলে নিয়ে তাঁদের অক্সিজেন ও স্যালাইন দেওয়া হয়।
এই চার উদ্ধারকর্মী জানান, ভবনের ভেতর থেকে তাঁরা ১০০-এর বেশি পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তার হাতে দিয়েছেন। যাতে পরবর্তী সময়ে তাঁদের পরিবারের খোঁজ পাওয়া যায়।


Source: prothom-alo

0 comments:

Post a Comment