মাথার ওপরে খর রোদ। দরদর করে ঘাম ঝরছে গা বেয়ে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। পায়ের চাপে কাগজের ঠোঙার মতো দুমড়ে-মুচড়ে গেছে নয়তলা ভবনটি। হাজার হাজার মানুষ তাকিয়ে আছে সেদিকে।
মাথায় লাল কাপড়ের ফিতা বাঁধা একদল তরুণ আর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কংক্রিটের খণ্ডের ওপর অতি সাবধানে পা ফেলে ফেলে ওঠা-নামা করছেন ধ্বংসস্তূপ বেয়ে। ফাঁকফোকর দিয়ে কেউ হাত, কেউ মাথা বা শরীরের অর্ধেকটা গলিয়ে দিয়েছেন। চেষ্টা করছেন দেখার। ভেতর থেকে ভেসে আসছে আর্তনাদ। আসছে করুণ আকুতি, ‘ভাই, আমারে বাইর করেন।’
বের করা সহজ নয়। ভবনটি এমনভাবে ধসে পড়েছে যে, ভেতরে আটকে পড়া লোকদের বের করে আনার মতো পথটাই পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে কে! দুর্ঘটনাকবলিত লোকদের উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষ।
ধ্বংসস্তূপের ভেতর চাপা পড়া একটি করে মানুষকে উদ্ধারকর্মীরা বের করে আনছিলেন। পুলিশ, র্যাব ও সেনাসদস্যরা রাস্তার সামনে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে ভিড় ঠেকাতে ব্যস্ত। সেই ভিড় থেকে উঠছিল ব্যাকুল জিজ্ঞাসা, ‘ভাই, বেঁচে আছে?’ সামনের সারিতে থাকা কেউ হয়তো এক ঝলকে দেখতে পেলেন স্ট্রেচারে নামানো মানুষটি নড়েচড়ে উঠছে। তিনি চিৎকার করে বলছেন, ‘বাঁইচা আছে, বাঁইচা আছে।’ সেই কথাতেই ভিড়ের মধ্যে নেমে আসে স্বস্তি। কে সে? কী নাম? কী পরিচয়—আপাতত তার দরকার নেই। ওসব পরে হবে। আগে জানা দরকার জীবিত না মৃত। ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনা মানুষটি বেঁচে আছে শুনেই বুক থেকে যেন পাষাণের ভার নেমে যাচ্ছে সবার। ‘বেঁচে আছে’—এর চেয়ে যেন ভালো সংবাদ আর ছিল না গতকালের সাভারে।
উল্টো ঘটনাও ঘটছে। থেঁতলে যাওয়া রক্তাক্ত কোনো দেহ বের করে আনলে নির্বাক হয়ে পড়ছিল হাজার মানুষের ভিড়। উদ্ধারকর্মীরা দ্রুত দেহটিকে পলিথিনে জড়িয়ে তুলে দিচ্ছিলেন শববাহী গাড়িতে। মৃত্যুর সেই বীভৎসতার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠতেই ভিড়ের মধ্য থেকে রোল উঠছিল কান্নার। কে জানে কার আপনজন চিরজন্মের জন্য চলে গেল মমতার বন্ধন ছিন্ন করে।
সাভার বাসস্ট্যান্ডের পূর্ব পাশে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কঘেঁষা নয়তলা রানা প্লাজা এবং তার দক্ষিণ দিকের একটি তিনতলা ভবন ধসে পড়েছিল গতকাল বুধবার সকালে। উত্তর দিকের ভবনগুলোর ক্ষতি হয়নি। পেছনে পূর্বদিকে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা আর মাঝারি আকারের একটি জলাশয়। পুরো এলাকাটি জনারণ্যে পরিণত হয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন নীল টি-শার্ট পরা যুবক ফরিদপুর সদরের মসজিদপুরের আহমদ মোল্লা। তিনি ওই তৈরি পোশাক কারখানায় কাটিং বিভাগে কাজ করতেন ছয় তলায়। বছর খানেক আগে বিয়ে হয়েছে কুলসুম বেগমের সঙ্গে। কুলসুম কাজ করেন মেশিন অপারেটর হিসেবে, পাঁচ তলায়। আহমদ বলেন, ‘সকালে দুই জন এক লগে কামে আইছি। আমি ছয় তলায় কাপড় কাটতেছি। পায়ের তলায় মনে হইলো মাইঝা (মেঝে) কাঁইপ্যা উঠল। হ্যার লগে লগেই ধপাস কইরা পইড়া গেল’।
ঘটনাস্থল থেকে উত্তর দিকে প্রায় তিন কিলোমিটার আগে গেন্ডার কাছে রাস্তায় বাঁশ দিয়ে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করে যানবাহন প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করছিলেন এলাকার সাধারণ মানুষ। সেখান থেকেই ঘটনাস্থলে হেঁটে যাচ্ছিলেন হাজার হাজার লোক। যেন জনস্রোত। অনেকে ঘটনা দেখতে আসছেন। কারও কারও হাতে প্রিয়জনের ছবি। তাঁদের অনেকেই কাঁদতে কাঁদতে ছুটছেন দুর্ঘটনাকবলিত ভবনের দিকে।
দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হতাহত ব্যক্তিদের নিয়ে আসা হচ্ছিল এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মুখে বাঁশি, হাতে লাঠি নিয়ে পথের পাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা। চলমান জনস্রোতকে সড়ক থেকে সরিয়ে নির্বিঘ্নে অ্যাম্বুলেন্সের যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দিচ্ছিলেন তাঁরা। বাঁশির শব্দ, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন আর অসংখ্য মানুষের আহাজারিতে এলাকার পরিবেশটাই এমন হয়ে উঠেছিল, যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
দুর্যোগের সময় যে মানুষ আপন-পর ভুলে যায়, স্বার্থ ভুলে যায়—সেই মহৎ মানবিকতাই উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল গতকাল সাভারে। শত শত সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছায় উদ্ধারকাজের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। দমকলকর্মীরা ধ্বংসস্তূপের ওপর থেকে মোটা ক্যানভাস ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। হতাহত যাঁকেই পাওয়া যাচ্ছিল, তাঁদের সেই ক্যানভাসে করে ঝুলিয়ে নিচের দিকে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। কাউকে কাউকে নামিয়ে আনা হচ্ছিল পাঁজাকোলা করে। স্বেচ্ছাসেবকেরা তৎক্ষণাৎ রক্তাক্ত বা ধুলাবালিতে আচ্ছন্ন লোকটিকে স্ট্রেচারে তুলে নিয়ে ছুটছিলেন পথে সারি করে রাখা অ্যাম্বুলেন্সের দিকে। এ অ্যাম্বুলেন্সগুলোও ছিল বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের। স্বেচ্ছায় তাঁরা হতাহত ব্যক্তিদের বহন করছিলেন। উদ্ধারকর্মীদের একজন উলন এলাকার ফাইবার গ্লাস কারখানার কর্মী মোহাম্মদ আলম। কখনো লাঠি হাতে ভিড় ঠেকাচ্ছেন। কখনো স্ট্রেচার ধরে আহত ব্যক্তিদের তুলে দিচ্ছেন অ্যাম্বুলেন্সে। তিনি জানালেন, সকাল থেকেই নেমে পড়েছেন। এত মানুষ হতাহত হয়েছে; ঘরে বসে থাকতে পারেননি।
পথের পাশ দিয়ে লোকজনকে পানি পান করানোর জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান বড় বড় ড্রামে পানি সরবরাহ করছিল। থানা রোডের পাশে ‘বুমবুম’ নামের একটি আসবাব তৈরির প্রতিষ্ঠানের সামনে দেওয়া হচ্ছিল ট্যাং মেশানো শরবত। এ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কড়া রোদে লোকজন ছোটাছুটি করছে। তাই তাদের জন্য সামান্য ব্যবস্থা করেছি। কয় টাকাই বা খরচ হচ্ছে।’
সাড়ে চার শ ব্যাগের মতো রক্ত দিয়েছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষার্থীরা। শল্যচিকিৎসকেরা বিরতিহীন অস্ত্রোপচার করছেন। পথের পাশেই মেডিকেল ক্যাম্প করেছেন গণস্বাস্থ্যের কর্মীরা। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক রায়হান আলম বলেন, ‘আমরা এখানে গুরুতর আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিচ্ছি।’ এ ক্যাম্পে দেওয়া হচ্ছিল বোতলে ভরা খাবার স্যালাইন। পাশেই রেড ক্রিসেন্ট ও ফায়ার সার্ভিসের মেডিকেল ক্যাম্পেও প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। থানা রোডের পাশে সাভার প্রাইম হাসপাতাল, রেজিয়া ক্লিনিকসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রেও খুলে রাখা হয়েছিল বিনা মূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য।
ঢাকায় পোশাক কারখানায় দুর্ঘটনা নতুন নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটে অগ্নিকাণ্ড। প্রাণহানি বিপুল। তবে আগুন লাগলেও কিছুটা সময় পাওয়া যায়। অনেকে ছোটাছুটি করে কারখানার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু রানা প্লাজা হতভাগ্য শ্রমিকদের সেই সময়টুকুও দেয়নি। নিমেষে হুড়মুড় করে ধসে পড়েছে মাথার ওপর। বন্ধ হয়ে গেছে বের হওয়ার পথ। অত বড় একটি ভবন যে এমন করে ধসে যেতে পারে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সেই কঠিন-করুণ বাস্তবতাই মাথা পেতে নিয়েছেন জীবিকার দায়ে ঠেকা কয়েক হাজার মানুষ। প্রাণ এক আশ্চর্য অমূল্য সম্পদ। অথচ এ দেশে কত প্রাণ অকাতরে চলে যায়, কত অসময়ে!
মাথায় লাল কাপড়ের ফিতা বাঁধা একদল তরুণ আর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কংক্রিটের খণ্ডের ওপর অতি সাবধানে পা ফেলে ফেলে ওঠা-নামা করছেন ধ্বংসস্তূপ বেয়ে। ফাঁকফোকর দিয়ে কেউ হাত, কেউ মাথা বা শরীরের অর্ধেকটা গলিয়ে দিয়েছেন। চেষ্টা করছেন দেখার। ভেতর থেকে ভেসে আসছে আর্তনাদ। আসছে করুণ আকুতি, ‘ভাই, আমারে বাইর করেন।’
বের করা সহজ নয়। ভবনটি এমনভাবে ধসে পড়েছে যে, ভেতরে আটকে পড়া লোকদের বের করে আনার মতো পথটাই পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে কে! দুর্ঘটনাকবলিত লোকদের উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষ।
ধ্বংসস্তূপের ভেতর চাপা পড়া একটি করে মানুষকে উদ্ধারকর্মীরা বের করে আনছিলেন। পুলিশ, র্যাব ও সেনাসদস্যরা রাস্তার সামনে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে ভিড় ঠেকাতে ব্যস্ত। সেই ভিড় থেকে উঠছিল ব্যাকুল জিজ্ঞাসা, ‘ভাই, বেঁচে আছে?’ সামনের সারিতে থাকা কেউ হয়তো এক ঝলকে দেখতে পেলেন স্ট্রেচারে নামানো মানুষটি নড়েচড়ে উঠছে। তিনি চিৎকার করে বলছেন, ‘বাঁইচা আছে, বাঁইচা আছে।’ সেই কথাতেই ভিড়ের মধ্যে নেমে আসে স্বস্তি। কে সে? কী নাম? কী পরিচয়—আপাতত তার দরকার নেই। ওসব পরে হবে। আগে জানা দরকার জীবিত না মৃত। ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনা মানুষটি বেঁচে আছে শুনেই বুক থেকে যেন পাষাণের ভার নেমে যাচ্ছে সবার। ‘বেঁচে আছে’—এর চেয়ে যেন ভালো সংবাদ আর ছিল না গতকালের সাভারে।
উল্টো ঘটনাও ঘটছে। থেঁতলে যাওয়া রক্তাক্ত কোনো দেহ বের করে আনলে নির্বাক হয়ে পড়ছিল হাজার মানুষের ভিড়। উদ্ধারকর্মীরা দ্রুত দেহটিকে পলিথিনে জড়িয়ে তুলে দিচ্ছিলেন শববাহী গাড়িতে। মৃত্যুর সেই বীভৎসতার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠতেই ভিড়ের মধ্য থেকে রোল উঠছিল কান্নার। কে জানে কার আপনজন চিরজন্মের জন্য চলে গেল মমতার বন্ধন ছিন্ন করে।
সাভার বাসস্ট্যান্ডের পূর্ব পাশে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কঘেঁষা নয়তলা রানা প্লাজা এবং তার দক্ষিণ দিকের একটি তিনতলা ভবন ধসে পড়েছিল গতকাল বুধবার সকালে। উত্তর দিকের ভবনগুলোর ক্ষতি হয়নি। পেছনে পূর্বদিকে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা আর মাঝারি আকারের একটি জলাশয়। পুরো এলাকাটি জনারণ্যে পরিণত হয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন নীল টি-শার্ট পরা যুবক ফরিদপুর সদরের মসজিদপুরের আহমদ মোল্লা। তিনি ওই তৈরি পোশাক কারখানায় কাটিং বিভাগে কাজ করতেন ছয় তলায়। বছর খানেক আগে বিয়ে হয়েছে কুলসুম বেগমের সঙ্গে। কুলসুম কাজ করেন মেশিন অপারেটর হিসেবে, পাঁচ তলায়। আহমদ বলেন, ‘সকালে দুই জন এক লগে কামে আইছি। আমি ছয় তলায় কাপড় কাটতেছি। পায়ের তলায় মনে হইলো মাইঝা (মেঝে) কাঁইপ্যা উঠল। হ্যার লগে লগেই ধপাস কইরা পইড়া গেল’।
ঘটনাস্থল থেকে উত্তর দিকে প্রায় তিন কিলোমিটার আগে গেন্ডার কাছে রাস্তায় বাঁশ দিয়ে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করে যানবাহন প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করছিলেন এলাকার সাধারণ মানুষ। সেখান থেকেই ঘটনাস্থলে হেঁটে যাচ্ছিলেন হাজার হাজার লোক। যেন জনস্রোত। অনেকে ঘটনা দেখতে আসছেন। কারও কারও হাতে প্রিয়জনের ছবি। তাঁদের অনেকেই কাঁদতে কাঁদতে ছুটছেন দুর্ঘটনাকবলিত ভবনের দিকে।
দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হতাহত ব্যক্তিদের নিয়ে আসা হচ্ছিল এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মুখে বাঁশি, হাতে লাঠি নিয়ে পথের পাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা। চলমান জনস্রোতকে সড়ক থেকে সরিয়ে নির্বিঘ্নে অ্যাম্বুলেন্সের যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দিচ্ছিলেন তাঁরা। বাঁশির শব্দ, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন আর অসংখ্য মানুষের আহাজারিতে এলাকার পরিবেশটাই এমন হয়ে উঠেছিল, যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
দুর্যোগের সময় যে মানুষ আপন-পর ভুলে যায়, স্বার্থ ভুলে যায়—সেই মহৎ মানবিকতাই উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল গতকাল সাভারে। শত শত সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছায় উদ্ধারকাজের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। দমকলকর্মীরা ধ্বংসস্তূপের ওপর থেকে মোটা ক্যানভাস ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। হতাহত যাঁকেই পাওয়া যাচ্ছিল, তাঁদের সেই ক্যানভাসে করে ঝুলিয়ে নিচের দিকে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। কাউকে কাউকে নামিয়ে আনা হচ্ছিল পাঁজাকোলা করে। স্বেচ্ছাসেবকেরা তৎক্ষণাৎ রক্তাক্ত বা ধুলাবালিতে আচ্ছন্ন লোকটিকে স্ট্রেচারে তুলে নিয়ে ছুটছিলেন পথে সারি করে রাখা অ্যাম্বুলেন্সের দিকে। এ অ্যাম্বুলেন্সগুলোও ছিল বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের। স্বেচ্ছায় তাঁরা হতাহত ব্যক্তিদের বহন করছিলেন। উদ্ধারকর্মীদের একজন উলন এলাকার ফাইবার গ্লাস কারখানার কর্মী মোহাম্মদ আলম। কখনো লাঠি হাতে ভিড় ঠেকাচ্ছেন। কখনো স্ট্রেচার ধরে আহত ব্যক্তিদের তুলে দিচ্ছেন অ্যাম্বুলেন্সে। তিনি জানালেন, সকাল থেকেই নেমে পড়েছেন। এত মানুষ হতাহত হয়েছে; ঘরে বসে থাকতে পারেননি।
পথের পাশ দিয়ে লোকজনকে পানি পান করানোর জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান বড় বড় ড্রামে পানি সরবরাহ করছিল। থানা রোডের পাশে ‘বুমবুম’ নামের একটি আসবাব তৈরির প্রতিষ্ঠানের সামনে দেওয়া হচ্ছিল ট্যাং মেশানো শরবত। এ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কড়া রোদে লোকজন ছোটাছুটি করছে। তাই তাদের জন্য সামান্য ব্যবস্থা করেছি। কয় টাকাই বা খরচ হচ্ছে।’
সাড়ে চার শ ব্যাগের মতো রক্ত দিয়েছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষার্থীরা। শল্যচিকিৎসকেরা বিরতিহীন অস্ত্রোপচার করছেন। পথের পাশেই মেডিকেল ক্যাম্প করেছেন গণস্বাস্থ্যের কর্মীরা। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক রায়হান আলম বলেন, ‘আমরা এখানে গুরুতর আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিচ্ছি।’ এ ক্যাম্পে দেওয়া হচ্ছিল বোতলে ভরা খাবার স্যালাইন। পাশেই রেড ক্রিসেন্ট ও ফায়ার সার্ভিসের মেডিকেল ক্যাম্পেও প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। থানা রোডের পাশে সাভার প্রাইম হাসপাতাল, রেজিয়া ক্লিনিকসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রেও খুলে রাখা হয়েছিল বিনা মূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য।
ঢাকায় পোশাক কারখানায় দুর্ঘটনা নতুন নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটে অগ্নিকাণ্ড। প্রাণহানি বিপুল। তবে আগুন লাগলেও কিছুটা সময় পাওয়া যায়। অনেকে ছোটাছুটি করে কারখানার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু রানা প্লাজা হতভাগ্য শ্রমিকদের সেই সময়টুকুও দেয়নি। নিমেষে হুড়মুড় করে ধসে পড়েছে মাথার ওপর। বন্ধ হয়ে গেছে বের হওয়ার পথ। অত বড় একটি ভবন যে এমন করে ধসে যেতে পারে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সেই কঠিন-করুণ বাস্তবতাই মাথা পেতে নিয়েছেন জীবিকার দায়ে ঠেকা কয়েক হাজার মানুষ। প্রাণ এক আশ্চর্য অমূল্য সম্পদ। অথচ এ দেশে কত প্রাণ অকাতরে চলে যায়, কত অসময়ে!
0 comments:
Post a Comment