Wednesday 1 May 2013

মোশাররফ নিষিদ্ধ হলে এরশাদ নয় কেন?

পাকিস্তানের পেশোয়ার হাইকোর্ট দেশটির সাবেক স্বৈরশাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফের রাজনীতি সারা জীবনের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। বৃহস্পতিবার বিচারপতি দোস্ত মোহাম্মদের নেতৃত্বধীন হাইকোর্টের চার সদস্যের একটি বেঞ্চ দুই দফা সংবিধান লঙ্ঘন এবং অবৈধভাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণার দায়ে এই সিদ্ধান্ত নেন। আদালাত বলেছেন, পারভেজ মোশাররফ আগামীতে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ, সিনেট কিংবা প্রাদেশিক পরিষদের কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।
Bangladeshi News24
জেনারেল পারভেজ মোশাররফ পাকিস্তানের সেনাপ্রধান থাকাকালে ১৯৯৯ সালে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। পূর্বসূরি আইউব খান, ইয়াহিয়া খান ও জিয়াউল হকের মতো তিনিও দেশের দুরবস্থার জন্য ঢালাওভাবে রাজনীতিকদের ওপর দোষ চাপান। আবার কিছুদিন না যেতেই নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে বিভিন্ন দল থেকে লোক ভাগিয়ে এনে রাজনৈতিক দল গঠন করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ২০০৮ সালে নির্বাচনের পর তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। দীর্ঘ নির্বাসন কাটিয়ে গত মাসে দেশে ফিরে আসেন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তাঁর মনোনয়ন বাতিল করে দেয়। সেই বাতিল আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলে পেশোয়ার হাইকোর্ট উপরোক্ত আদেশ দেন। বেনজির ভুট্টোর হত্যা মামলাসহ বেশ কিছু মামলায় তিনি অভিযুক্ত এবং নিজ বাড়িতে অন্তরীণ রয়েছেন।
পাকিস্তানে প্রতি দশকেই একজন উর্দিপরা ত্রাতা আসেন। তাঁরা দেশকে উদ্ধার করতে না পারলেও নিজেদের উদ্ধার করেন। ২০০৭ সালে যে চুক্তির মাধ্যমে পারভেজ মোশাররফ বেনজির ভুট্টোকে দেশে আসার এবং রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে নিয়েছিলেন, সেই চুক্তি তাঁর বা তাঁর উত্তরসূরি আসিফ আলী জারদারির রক্ষাকবচ হয়নি। তাঁর সবচেয়ে আত্মঘাতী কাজ ছিল প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহাম্মদ চৌধুরীকে বরখাস্ত করা এবং বিচারপতিদের অন্তরীণ করে রাখা। বেনজির হত্যা মামলার পাশাপাশি বিচারক হয়রানির মামলাটি এখনো তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তিনি যে কেবল নির্বাচনী লড়াই থেকে বাদ পড়েছেন তা-ই নয়, নাগরিক হিসেবে তিনি ভোটটি দিতে পারবেন কি না, সন্দেহ আছে। কেননা, তাঁর অন্তরীণের আদেশ আরও ১৫ দিন বাড়ানো হয়েছে। ১১ মের নির্বাচনে তাঁকে নিজ গৃহে বন্দী থাকতে হবে। 
পাকিস্তানের উচ্চ আদালত যখন পাকিস্তানের সাবেক স্বৈরশাসকের সব ধরনের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে, তখন বাংলাদেশের সাবেক স্বৈরশাসক রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। কখনো তিনি আগামী নির্বাচনে কিং মেকার হবেন বলে ঘোষণা দিচ্ছেন, কখনো নিজেই কিং হওয়ার খোয়াব দেখছেন। সকালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে মহাজোট জোরদার করার কথা বললে বিকেলেই হয়তো দলীয় সভায় জোট ছাড়ার আওয়াজ তোলেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বিতর্কিত, সবচেয়ে ধিক্কৃত ব্যক্তি রাজনীতির মাঠ সরগরম করতে পারছেন গণতন্ত্রের দুই প্রধান দাবিদার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ব্যর্থতা ও দুর্বলতার কারণে। এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বন্দুকের নলের মুখে দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। তাঁর নয় বছরের শাসন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। তিনিও পূর্বসূরি জিয়াউর রহমানের মতো সত্ ‘রাজনীতিকে কঠিন’ করে দিয়ে কেনাবেচার রাজনীতি শুরু করেন। পাইকারিহারে বিরোধী দলের নেতাদের জেলে পোরেন। আফসোসের কথা, নূর হোসেন, তাজুল, সেলিম, দেলোয়ারসহ অসংখ্য গণতন্ত্রকামী মানুষের রক্তে যাঁর হাত রঞ্জিত, সেই স্বৈরশাসকই আজ আমাদের গণতন্ত্র সম্পর্কে দিনরাত সবক দিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমানে যে আদর্শিক সংকট চলছে, মৌলবাদী গোষ্ঠী রাষ্ট্রের মৌল চরিত্র বদলে দেওয়ার দাবি তুলছে, তার ক্ষেত্রটি কিন্তু প্রস্তুত করেছিলেন দুই সামরিক শাসক—জিয়াউর রহমান ও এরশাদ। তাঁরা দুজনই জোর করে বন্দুকের নলে ক্ষমতায় এসে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও রাজাকারদের পুনর্বাসন করেন, একজন রাজাকারকে প্রধানমন্ত্রী করেন। বাংলাদেশে রাষ্ট্রে মৌল আদর্শ বদলে দিয়ে সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী আনেন। আর এমন কোনো অনাচার নেই যা এরশাদ করেননি। তিনি রাষ্ট্রধর্ম চালু করেন। যদিও ধর্মের চেয়ে অধর্মের প্রতিই তাঁর ঝোঁক বেশি ছিল এবং এখনো আছে। 
পাকিস্তানে পারভেজ মোশাররফ সংবিধান লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার জন্য যদি চিরদিনের জন্য তাঁর রাজনীতি করা নিষিদ্ধ হতে পারে, বাংলাদেশে একই কাজ যিনি বা যাঁরা করেছেন, তিনি বা তাঁরা কেন নিষিদ্ধ হবেন না। তত্ত্বাধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে বিচারপতি খায়রুল হক বিতর্কিত হয়েছেন। এই রায়ের মাধ্যমে তিনি রাজনীতির অঙ্গনে একটি অহেতুক বিতর্ক উসকে দিয়েছেন বলেও অনেকে মনে করেন। 
কিন্তু সংবিধানের পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনী সম্পর্কে তাঁর রায় বাংলাদেশের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। এই রায়ই প্রথম জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করে। এরপর সপ্তম সংশোধনীর বিষয়েও একই রকম রায় আসে।
কিন্তু পাকিস্তানের আদালত অবৈধ ক্ষমতাদখলকারীর রাজনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নিলেও বাংলাদেশের আদালত সে সম্পর্কে কিছু বলেননি। কেবল সামরিক শাসনকে অবৈধ আখ্যা দিয়েছেন। আমরা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে অবৈধভাবে ক্ষমতাদখলকারীর বিরুদ্ধেও রায় চাই। তাহলে ভবিষ্যতে কেউ সংবিধান লংঘনের ঘটনা ঘটাতে সাহস পাবেন না। 
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী আওয়ামী লীগ বায়াত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার ফাঁকা আওয়াজ তুললেও মূল সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপন করেনি; যদিও আদালতের রায়ে এ ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা ছিল। 
এই সুযোগে সাবেক স্বৈরাচার ও সাবেক রাজাকার— দুই প্রধান দলের ওপর সওয়ার হয়েছে। আর রণহুংকার ছাড়ছে ‘ধর্ম রক্ষার ফেরিওয়ালারা।’

source: prothom-alo

0 comments:

Post a Comment